মুঘল আমলের স্থাপত্য ও চিত্রকলা
আজকে আমাদের আলোচ্য বিষয় – মুঘল আমলের স্থাপত্য ও চিত্রকলা । ভারতের ইতিহাসে মুঘল মুঘল আমলের স্থাপত্য ও চিত্রকলা স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। মুঘল শাসকেরা ভারতে বিশাল ও স্থায়ী সাম্রাজ্য গঠনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে অপরূপ স্থাপত্য শিল্প গঠনের দ্বারা সুসজ্জিত ও সমৃদ্ধ করেছিলেন । তাদের অধিকাংশ সৃষ্টি আজও বর্তমান এবং এ যুগেও তা সৌন্দর্য রসিকদের বিস্ময় সৃষ্টি করে । Mughol Amoler Sthapotyo o Chitrokola । Architecture during Mughal Period । মূঘল যুগের স্থাপত্য ও চিত্রকলা । mughol juger sthapotyo |
Table of Contents
Also Check : ভারতের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য ও প্রতিষ্ঠাতা PDF
মুঘল যুগের বিখ্যাত স্থাপত্য
১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বিজয় ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের নতুন অধ্যায় শুরু করে। মুঘল সম্রাটের ভারতে স্থাপত্য ক্ষেত্রে যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।
বিশিষ্ট সমালােচক ফারগুসন ( Fergussion ) এর মতানুযায়ী মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প পারসিক স্থাপত্যশৈলীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। বিশেষত এই যুগে নির্মিত থামযুক্ত প্রাসাদ বা গম্বুজ প্রভৃতির সাথে পারসিক স্থাপত্যের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায় ।
অপরদিকে সমালোচক হ্যাভেল ( Havell ) মুঘল স্থাপত্যকর্মের মধ্যে কিছু কিছু পারসিক স্থাপত্যকর্মের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন।
অন্যদিকে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ মুঘল-স্থাপত্যরীতির মধ্যে ভারতীয় ও পারসিক রীতির সংমিশ্রণে উদ্ভূত এক স্বতন্ত্র শিল্পকর্ম খুঁজে পেয়েছেন। তাদের মতে মুঘল স্থাপত্যকর্ম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও নতুন কোনাে সৃষ্টি নয়। সুলতানি যুগের স্থাপত্যশৈলী আরও পরিমার্জিত হয়ে মুঘল যুগে বিকশিত হয়েছিল । সম্রাটদের ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার পরিপ্রেক্ষিতে তা নতুন থেকে নতুনতর রূপে বিকশিত হয়েছিল ।
জন্ মার্শালের মতে , এই বিশাল ভারতবর্ষে একটিমাত্র রীতি অনুসৃত হত — একথা ভাবা ঠিক নয় । কারণ আঞ্চলিক বিভিন্নতাহেতু বিভিন্ন অঞ্চলের স্থাপত্যকর্মে বৈচিত্র্য থাকা ছিল অবশ্যম্ভাবী ।
Also Check : বিশ্বের বিখ্যাত কিছু ভবন ও স্থাপত্য – PDF
দেখে নেওয়া যাক স্থাপত্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন মুঘল সম্রাটদের অবদান।
বাবর
- ১৫২৬ সালে বাবর পানিপথ ও রোহিলখণ্ডে একটি মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর আমলে নির্মিত সৌধগুলির মধ্যে পানিপথের কাবুল-বাগ-মসজিদ এবং সম্বলের জামা মসজিদ উল্লেখযােগ্য ।
- বাবরের বেশিদিন রাজত্ব না করে তার আমলে নতুন কোনো শিল্পরীতির উদ্ভব হয়নি।
হুমায়ুন
- বাবরের পরে তার স্থলাভিষিক্ত হন হুমায়ুন। কিন্তু হুমায়ূনের শাসনকালের অধিকাংশ সময় চলে যায় শের শাহ -এর সাথে যুদ্ধে।
- তিনি দিনপনাহ নামে একটি শহরের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন কিন্তু তিনি তা শেষ করতে পারেননি।
- হুমায়ূনের বিধবা পত্নী হামিদা বানু বেগম দিল্লিতে হুমায়ূনের সমাধি (Humayun’s Tomb ) নির্মাণ করেন যেটি ছিল ভারতে মুঘলদের নির্মিত প্রথম উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য। এটিকে তাজমহলের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত।
- হুমায়ূনের আমলে শিল্পরীতিতে পারসিক স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন পাওয়া যায়।
হামিদা বানু বেগম নির্মিত হুমায়ূনের সমাধি। ১৯৯৩ সালে এটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান ঘোষিত হয়।
Also Check : পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থান – স্থাপত্য ও নকশাকার-স্থপতি-নির্মাতা
আকবর
মুঘল-স্থাপত্যকর্মের প্রকৃত বিকাশ শুরু হয় সম্রাট আকবরের সময় থেকে । অবশ্য আকবর ভারতীয় ও পারসিক রীতির সংমিশ্রণে স্থাপত্য-নির্মাণে বেশি উৎসাহী ছিলেন। তার আমলে নির্মিত প্রাসাদ ও দুর্গগুলিতে ইন্দো -পারসিক রীতির সংমিশ্রণ দেখা যায়। লাল তার স্থাপত্যশিল্প বেলেপাথরের ব্যবহার ছিল মূল বৈশিষ্ট্য এবং তিনি টিউডার খিলানের (Tudor arch ) ব্যবহার প্রবর্তন করেন।
তাঁর আমলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যশিল্প –
- আগ্রা দুর্গ :
- আকবরের শাসনকালের প্রথম নির্মাণগুলির মধ্যে একটি।
- যমুনা নদীর তীরে লাল পাথর দিয়ে তৈরি।
- আগ্রাফোর্টের ভেতরের কিছু উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য হল –
- মতি মসজিদ (শাহজাহানের তৈরী )
- শাহজাহানের দেওয়ান-ই-আম (জনসাধারণের দর্শকদের হল)
- শাহজাহানের দেওয়ান-ই-খাস (ব্যক্তিগত দর্শকদের হল)
- জাহাঙ্গিরি মহল
- শীশ মহল (তুর্কি স্নান)
বিশ্বের উচ্চতম দরজা “বুলন্দ দরওয়াজা” । ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে আকবর নির্মাণ করেন। ফতেপুর সিক্রি মহলের প্রবেশদ্বার এটি।
- ফতেপুর সিক্রি :
- ফতেপুর সিক্রি ছিল আকবরের নির্মিত নতুন রাজধানী।
- ইন্দো-পার্সিয়ান শিল্পরীতিতে তৈরী এই স্থাপত্যকে ‘frozen moment in history’ বলে বর্ণনা করা হয়।
- ফতেপুর সিক্রির অন্তর্গত কিছু বিখ্যাত স্থাপত্য হল –
- বুলন্দ দরওয়াজা : ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে গুজরাট জয়ের স্মৃতি হিসেবে আকবর বুলন্দ দরওয়াজা নির্মাণ করেন। ৪০মিটার উঁচু এই দরজাটি বিশ্বের অন্যতম উচ্চ-প্রবেশদ্বার।
- সেলিম চিস্তির সমাধি : ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে সেলিম চিস্তির সমাধি আকবর ফতেপুর সিক্রিতে নির্মাণ করেন। সাদা মার্বেলে নির্মিত যায় সমাধির চারপাশের দেওয়ালে কোরানের বিভিন্ন বাণী লেখা রয়েছে।
- পঞ্চ মহল : পার্সিয়ান ব্যাজার দ্বারা অনুপ্রাণিত পাঁচ তলা কাঠামো দিয়ে এই পঞ্চ মহল নির্মাণ করা হয়।
- যোধা বাঈয়ের প্রাসাদ : আকবরের প্রিয় পত্নী যোধা বাঈয়ের প্রাসাদ রয়েছে ফতেপুর সিক্রির মধ্যে।
- ইবাদত খানা : ইবাদত খানা ছিল বিভিন্ন ধর্মের আলোচনা গৃহ।
- পচিসি কোর্ট : এটি একটি প্রাঙ্গন যেখানে আকবর দাবা খেলতেন।
- হিরণ মিনার : আকবরের প্রিয় হাতির স্মৃতিতে নির্মিত।
ফতেপুর সিক্রির স্থাপত্যশৈলীর বর্ণনা প্রসঙ্গে লেনপুল বলেছেন , ” Nothing sadder or more beautiful exist in India than deserted city , the silent Witness of a vanished adream . ” ফতেপুরের স্থাপত্য সৌন্দর্যকে ফারগুসন বলেছেন , “ মহৎপ্রাণের প্রতিবিম্ব ‘ এবং ভি. স্মিথ বলেছেন , পাথরে নির্মিত ‘ কল্পনা ও স্বপ্ন ‘ ।
এছাড়াও আকবর বৃন্দাবনে গোবিন্দ দেবের মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। অপরদিকে শিখগুরু রামদাসকে স্বর্ণ মন্দির নির্মাণের জন্য জমিও দান করেন তিনি।
জাহাঙ্গীর
জাহাঙ্গীর চিত্রকলা এবং অন্যান্য শিল্প ফর্মের উপর বেশি মনোযোগ দেন। তাঁর আমলের কিছু উল্লেখযোগ্য স্মৃতিস্তম্ভ ছিল-
- সিকান্দ্রায় আকবরের সমাধি।
- লাহোরে তার নিজের সমাধি।
- কাশ্মীরের শালিমার বাগ।
- লাহোরে মতি মসজিদ।
- ইতিমাদ-উদ-দৌলার সমাধিসৌধ – উত্তরপ্রদেশের আগ্রাতে অবস্থিত। একটিকে ছোট তাজমহল (“Bachcha Taj” , “Baby Taj” ) বলা হয়ে থাকে। জাহাঙ্গীরের আমলে এটি তার পত্রী নুরজাহান এটি তার পিতা মির্জা গিয়াস বেগ -এর জন্য নির্মাণ করেন। মির্জা গিয়াস বেগ -এর উপাধি ছিল ইতিমাদ-উদ-দৌলা । এটি ছিল প্রথম কাঠামো যা পিয়েত্রা দুরা ব্যবহার করে এবং প্রথম যমুনা নদীর তীরে নির্মিত হয়।
শাহ জাহান
শাহজাহানের রাজত্বকালে মুঘল স্থাপত্য শিল্প উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল। তাঁর আমলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য –
মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম যিনি মুমতাজ মহল নামে পরিচিত, তার স্মৃতির উদ্দেশে এই অপূর্ব সৌধটি নির্মাণ করেন। সৌধটির নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে যা সম্পূর্ণ হয়েছিল প্রায় ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। এটি ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল।
- তাজমহল
- ১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী মমতাজ মহল (আরজুমান্দ বানু) চতুর্দশ সন্তান গওহর বেগমের প্রসবের সময় মৃত্যুবরণ করেন। এই স্ত্রীর মৃত্যুতে শাহজাহান প্রচণ্ড শোকাহত হন এবং তাঁর স্মরণে তাজমহল নির্মাণ করেন।
- ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তাজমহলকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।
- দিল্লির লাল কেল্লা
- শাজাহান তার রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করেন । ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত লাল কেল্লা ছিল মুঘল সম্রাটদের রাজধানী।
- ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান সুবৃহৎ এই কেল্লাটির নির্মাণকার্য শুরু করেন। নির্মাণকার্য শেষ হয় ১৮৪৮ সালে।
- প্রথম দিকে এই দুর্গের নাম ছিল ‘কিলা-ই-মুবারক‘ (‘আশীর্বাদধন্য দুর্গ’); কারণ এই দুর্গে সম্রাটের পরিবারবর্গ বাস করতেন।
- দুর্গটি যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত।
- ২০০৭ সালে লালকেল্লা ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে নির্বাচিত হয়।
- দিল্লির জামা মসজিদ নির্মাণ করেন তিনি ।
- বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন নির্মিত হয় শাহজাহানের আমলে ।
ঔরঙ্গজেব
ঔরঙ্গজেবের আমল থেকে মুঘল স্থাপত্যের অবক্ষয় শুরু হয়। তিনি শিল্প ও স্থাপত্যের সাধনায় কোনো সক্রিয় আগ্রহ নেননি। তাঁর আমলের কিছু উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য হল –
- লাহোরের আলমগীর দরজা ।
- লাহোরের বাদশাহী মসজিদ। এটি পাকিস্তানের তৃতীয় ও বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম মসজিদ।
মহম্মদ আজম শাহ
- দিল্লতে তাঁর পত্নীর স্মরণে তিনি জিনাত মহল নির্মাণ করেন।
- ঔরঙ্গজেবের আমলে তাঁর পুত্র আজম শাহ তাঁর মা বেগম রাবিয়া দুরানির স্মৃতিতে তাজমহলের অনুকরণে বিবি-কা-মাকবারা নির্মাণ করেন।
Download Section
- File Name: মুঘল আমলের স্থাপত্য ও চিত্রকলা – বাংলা কুইজ
- File Size: 4.7 MB
- No. of Pages: 08
- Format: PDF
- Language: Bengali
To check our latest Posts - Click Here