Khudiram Bose Biography in Bengali : আজকে আমরা এই আর্টিকেলে আলোচনা করবো ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনী নিয়ে – ক্ষুদিরাম বসু। নামটি শুনলেই মনের মধ্যে শ্রদ্ধা ও চোখে চলে আসে অশ্রু। মাত্র ১৯ বছর বয়সে দেশের জন্য প্রাণ দেন তিনি। নির্ভীক এই ছেলেটি সেদিন ব্রিটিশদের দেখিয়ে দিয়েছিল বীর মায়ের সন্তানরা বুক ভর্তি ভয় নিয়ে বেঁচে থাকে না , প্রতিবাদী হয়ে দেশের জন্য প্রাণ দেবার ক্ষমতা রাখে তারা।
Table of Contents
ক্ষুদিরাম বসু সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
নাম (Name) | ক্ষুদিরাম বসু (Khudiram Bose) |
জন্ম (Birthday) | ৩ ডিসেম্বর ১৮৮৯ (3rd December 1889) |
জন্মস্থান (Birthplace) | মোহবনী (হবিবপুর), পশ্চিম মেদিনীপুর |
পিতা | ত্রৈলোক্যনাথ বসু |
মাতা | লক্ষ্মীপ্রিয় দেবী |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পরিচিতির কারণ | ভারতীয় বিপ্লবী |
রাজনৈতিক দল | অনুশীলন সমিতি |
আন্দোলন | ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন |
মৃত্যু (Death) | ১১ আগস্ট ১৯০৮ (11th August 1908) |
মৃত্যুর কারণ | মৃত্যুদণ্ড (ফাঁসি) |
ক্ষুদিরাম বসুর জন্ম
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৩সারা ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মেদিনীপুর (বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুর ) এর কেশপুর থানার হাবিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা – ত্রৈলোক্যনাথ বসু ও মাতা – লক্ষ্মীপ্রিয় দেবী। পেশায় তার পিত ছিলেন নাড়াজোলের তহসিলদার। তিন কন্যার পর মায়ের চতুর্থ সন্তান ছিলেন তিনি। খুদের বিনিময়ে কেনা হয়েছিল বলে শিশুটির নাম পরবর্তীকালে ক্ষুদিরাম রাখা হয়।
ক্ষুদিরামের দুই ভাই অকালে প্রাণ হারান। ভীত-সন্ত্রস্ত ক্ষুদিরামের মাতা এই ঘটনায় বিচলিত হয়ে তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী ক্ষুদিরামের বড় দিদির কাছে ক্ষুদিরামকে তিন মুঠো চালের খুদের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন।
ক্ষুদিরাম বসুর শৈশবকাল
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ক্ষুদিরাম বসু তার মাকে হারান। এর ঠিক এক বছর পর তার পিতারও মৃত্যু হয়। এমতাবস্থায় দিদি অপরূপা কাছে মানুষ হন তিনি। দিদি অপরূপা স্বামী অমৃতলাল রায় ক্ষুদিরামকে হ্যামিল্টন হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন। তবে অমৃতলালের ছিল বদলীর চাকরি। দীর্ঘদিন এক জায়গায় থাকতে পারতেন না এই চাকরির সুবাদে। তাই ক্ষুদিরামকেও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে হত দিদির সাথে।
ক্ষুদিরাম বসুর শিক্ষাজীবন
যখন অমৃতলাল মেদিনীপুরে বদলী হয়েছেন তখন তাকে ভর্তি করা হল মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে । এইস্কুলেরই একজন শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু । তার আদর্শে ক্ষুদিরাম বড় হতে থাকেন। লাঠি খেলা, ব্যায়াম দ্বারা ক্রমশ ধরে ধরে নিজেকে গড়ে তুলতে লাগলেন ক্ষুদিরাম।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু এবং রাজনারায়ণ বসুর প্রভাবে মেদিনীপুরে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠেছিল। সেই সংগঠনের নেতা ছিলেন হেমচন্দ্র দাস কানুনগো এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন হেমচন্দ্র দাসের সহকারী। এটি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ব্রিটিশবিরোধীদের দ্বারা পরিচালিত হতো। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ক্ষুদিরাম তার গুণাবলীর জন্য সবার চোখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন।
স্বদেশী আন্দোলন ও ক্ষুদিরাম
ক্ষুদিরাম সত্যেন্দ্রনাথের সাহায্যে বিপ্লবী দলভুক্ত হন ক্ষুদিরাম তারই নির্দেশে ‘সোনার বাংলা‘ শীর্ষক বিপ্লবাত্মক ইশতেহার বিলি করে গ্রেপ্তার হন। ১৯০৬ সালে কসাই নদীতে বন্যার সময় ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন ক্ষুদিরাম।
চারিদিকে তখন স্বদেশী আন্দোলন চলছিল। বিলাতি কাপড় ও বিলাতি নুন লুঠ করার কাজে তৎকালীন স্বদেশী নেতারা লেগে গেলেন। ১৯০৬ সালে মেদিনীপুরে মারাঠা কেল্লায় কৃষি – শিল্প প্রদর্শনী মেলা বসে। এই মেলায় ক্ষুদিরাম বিপ্লবী বই বিলি করতে থাকেন। নজরে পরে যান ব্রিটিশ পুলিশদের। প্রায় তিনমাস পুলিশের চোখে বালি দিয়ে তিনি তার কার্যকলাপ চালাতে থাকেন। কিন্তু একদিন তিনি ধরা পরে যান ব্রিটিশ পুলিশের কাছে। শুরু হয় ব্রিটিশ পুলিশের অকথ্য অত্যাচার। এই বিপ্লবী বই কোথা থেকে বেরিয়েছে জানার জন্য পুলিশ বিভিন্ন ভাবে ক্ষুদিরামের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালাতে থাকে। কিন্তু অকুতোভয় এই কিশোর মুখ বুঝে সব সহ্য করতে থাকেন। তার মুখ থেকে কোনো কথা বার করতে পারেননি ব্রিটিশ পুলিশরা। অবশেষে উপায় না দেখে তারা ক্ষুদিরামকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এই ঘটনার পর ক্ষুদিরামের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। দিনে দিকে তার সাহসিকতার গল্প শোনা যেতে লাগলো।
কিংসফোর্ডকে হত্যা করার প্রথম পরিকল্পনা
তৎকালীন মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন কিংসফোর্ড । এই ইংরেজ প্রশাসক ভারতীয়দের উপর নানা অত্যাচার শুরু করে। যুগান্তর মামলার বিরুদ্ধে প্রচারে অংশ নেওয়ায়, মাত্র ১২ বছর বয়সী সুশীল সেনকে চাবুকদিয়ে নির্মমভাবে প্রহার করেন কিংসফোর্ড। এই ঘটনা বিপ্লবীদের মধ্যে ক্রোধের দাবানল সৃষ্টি করে। তারা কোনোমতেই এই ঘটনা মেনে নিতে পারেননি। এক গােপন সভায় তারা ঠিক করলেন অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে । আর তার ভার দেওয়া হল ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর উপর ।
হেমচন্দ্রের তৈরি করা বই বোমা দিয়ে কিংসফোর্ডকে হত্যার প্রথম প্রচেষ্টা করা হয়। একটা ক্যাডবেরি কোকোর খালি টিনে এক পাউন্ড পিকরিক অ্যাসিড এবং তিনটে ডেটোনেটর দিয়ে এই বোমা বানানো হয়। বাদামি কাগজ দিয়ে মুড়ে নবীন বিপ্লবী পরেশ মল্লিক কিংসফোর্ডের বাড়িতে দিয়ে আসেন। কিন্তু কিংসফোর্ড এই প্যাকেট না খুলে তার সেলফে রেখে দেন। ঠিক এর পরেই কিংসফোর্ডের বদলি হয়ে যায় বিহারের মুজাফফরপুর জেলার বিচারপতি হিসেবে।
কিংসফোর্ডকে হত্যা করার দ্বিতীয় পরিকল্পনা
কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল মুজাফফরপুর পার্কে ব্রিটিশ ক্লাবের কাছে এসে লুকিয়ে থাকেন। এখানে প্রিঙ্গল কেনেডি নামে একজন ব্রিটিশ ব্যারিস্টারের মেয়ে এবং স্ত্রীর সঙ্গে কিংসফোর্ড এবং তার স্ত্রী মাঝে মধ্যেই ব্রিজ খেলতেন। সেদিন খেলার পরে ৮.৩০ নাগাদ সবাই বাড়ি ফেরার মনস্থ করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন কেনেডি মহিলাগণ কিংসফোর্ডের বাড়ির চত্বর থেকেই যাচ্ছিলেন। যখন তাদের গাড়ি ওই চত্বরের পূর্ব ফটকে পৌঁছায়, ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল গাড়িটার দিকে দৌড়ে যান এবং গাড়িতে বোমাগুলো ছোড়েন। একট প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে এবং গাড়িটা সঙ্গে সঙ্গে কিংসফোর্ডের বাড়িতে আনা হয়। গাড়িটা ভেঙে গিয়েছিল এবং কেনেডি মহিলাগণ ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। মিস কেনেডি এক ঘণ্টার মধ্যেই মারা যান এবং মিসেস কেনেডি গুরুতর আঘাতের ফলে ২ মে তারিখে প্রয়াত হন।
পলায়ন
বোমা মারার পরে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল পালিয়ে যেতে তৎপর হন। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি সমস্ত শহর এই ঘটনা যেতে যাওয়াতে রেলস্টেশনে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয়। উপায় নেই দেখে পায়ে হেঁটে তারা পালতে থাকেন। প্রায় ২৫ মাইল পায়ে হেঁটে ওয়াইনি নামে এক স্টেশনে পৌঁছান। যখন একটা চায়ের দোকানে তিনি এক গ্লাস জল চেয়েছিলেন, তখন তিনি ফতে সিং এবং শিউ প্রসাদ সিং নামে দুজন কনস্টেবলের মুখোমুখি হন, যারা তার ময়লা পা এবং বিধ্বস্ত ও ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে কিছু সন্দেহ করেছিল। কয়েকটা প্রশ্ন করার পর তাদের সন্দেহ বেড়ে যায় এবং তারা ক্ষুদিরামকে আটক করার সিদ্ধান্ত নেয়। ক্ষুদিরাম তাদের দুজনের সঙ্গে সংগ্রাম শুরু করে এবং তৎক্ষণাৎ দুটো রিভলভারের একটা পড়ে যায়। অন্য রিভলভারটা দিয়ে কনস্টেবলদেরকে গুলি করতে উদ্যত হওয়ার আগেই কনস্টেবলদের একজন ক্ষুদিরামকে পিছন দিক থেকে মজবুত আলিঙ্গনাবদ্ধ করে ধরে ফেলে। নবীনতর এবং হালকা চেহারার ক্ষুদিরামের পক্ষে নিজের প্রতিরক্ষা অথবা অব্যাহতি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিলনা। তার কাছে ৩৭ রাউন্ড গোলাগুলি, ৩০ টাকা নগদ, একটা রেলপথের মানচিত্র এবং একপাতা রেলের সময়সারণি ছিল। ক্ষুদিরাম চিরকালের জন্যে ধরা পড়ে গেলেন! ওয়াইনি রেল স্টেশনটা বর্তমানে নাম বদল করে হয়েছে ক্ষুদিরাম বসু পুসা স্টেশন।
ক্ষুদিরামের ফাঁসি
৩০ এপ্রিল ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে মুজাফফরপুর, বিহারে রাতে সাড়ে আটটায় ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুড়ে তিনজনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ক্ষুদিরামের বিচার শুরু হয় ২১ মে ১৯০৮ তারিখে যা আলিপুর বোমা মামলা নামে পরিচিত হয়। বিচারক ছিলেন জনৈক ব্রিটিশ মি. কর্নডফ এবং দুজন ভারতীয়, লাথুনিপ্রসাদ ও জানকীপ্রসাদ। রায় শোনার পরে ক্ষুদিরামের মুখে হাসি দেখা যায়। তার বয়স খুব কম ছিল।
১১ই অগাস্ট তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ভোর ছ-টায়। ফাসির মঞ্চ ওঠার সময়ে তিনি হাসিখুশি ছিলেন। ক্ষুদিরামকে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা লিখেছিলেন এবং অনেক গানও তখন রচিত হয়েছিল। যেমন, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’।
To check our latest Posts - Click Here