রচনা

পঞ্চানন বর্মা জীবনী – প্রতিবেদন রচনা

পঞ্চানন বর্মা জীবনী – প্রতিবেদন রচনা

আজ আমরা জানব কোচবিহার তথা বাংলার একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তির সম্পর্কে। এনার সম্পর্কে আমাদের মধ্যে অনেকেই অবহিত নন, কিন্তু উত্তরবঙ্গের ইতিহাসে ইনি একজন গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী মানুষ। ( পঞ্চানন বর্মা জীবনী প্রতিবেদন রচনাPanchanan Barma )

ইনি ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা। 

Also Check : কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় জীবনী – প্রতিবেদন রচনা

পঞ্চানন বর্মা ছিলেন কোচবিহারের একজন রাজবংশী নেতা, আইনজীবী, এবং সমাজ সংস্কারক। ব্রাহ্মণ্য মূল্যবোধ এবং রীতিনীতির প্রচারের জন্য তিনি ক্ষত্রিয় সভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা

২০২০ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গ সরকার পঞ্চানন বর্মার জন্মদিন স্কুলস্তরে সরকারী ছুটি ঘোষণা করেছেন। ছুটির সরকারী দিন হল পহেলা ফাল্গুন – যা বছরফেরে ১৩ই বা ১৪ই ফেব্রুয়ারি তারিখ হতে পারে। ২০২২ সালে এই দিনটি ১৪ই ফেব্রয়ারি পড়েছে।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া

Also Check : লতা মঙ্গেশকর – লতাজীর জীবনী – Biography of Lataji

জন্মঃ

পঞ্চানন বর্মা ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই ফেব্রুয়ারি পূর্বতন কোচবিহার রাজ্যের মাথাভাঙ্গা মহকুমার খলিসামারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই স্থানটি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায় অবস্থিত।

তাঁর জন্মের সময় কোচবিহার ছিল ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত একটি রাজ্য। কোচবিহারের রাজা এই রাজ্য শাসন করতেন। 

জন্মের সময় পঞ্চানন বর্মার নাম রাখা হয়েছিল পঞ্চানন সরকার

Also Check : ডঃ বি আর আম্বেদকর জীবনী – প্রতিবেদন – রচনা – Dr. B.R. Ambedkar

পরিবারঃ

পঞ্চানন বর্মার পিতার নাম ছিল খোসাল সরকার এবং মাতার নাম ছিল চম্পলা সরকার। তাঁর পিতা ছিলেন একজন জোতদার এবং মহকুমা কাছারীর মোক্তার। মোক্তার কথাটি আজকাল ব্যবহৃত হয় না বটে, কিন্তু সেই সময়ে অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলা এবং ইংরাজি দুই ভাষায় দক্ষ উকিলদের মোক্তার বলা হত। 

শিক্ষাঃ

পঞ্চানন বর্মা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করেন। তাঁর স্কুলের নাম মাথাভাঙ্গা হাই স্কুল। সেখানে মিডল ইংলিশ শিক্ষালাভের পরে তিনি কোচবিহারের জেনকিন্স স্কুলে হাই ইংলিশ শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। 

স্কুল শিক্ষার পরে স্নাতকস্তরের শিক্ষালাভ করেন ভিক্টোরিয়া কলেজে, যার বর্তমান নাম আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কলেজ। স্নাতকস্তরে তাঁর শিক্ষার বিষয় ছিল সংস্কৃত। তিনি স্নাতক হন ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে।

তিনি স্নাতকোত্তর শিক্ষালাভ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তাঁর শিক্ষার বিষয় ছিল সংস্কৃত (M.A.), যা তিনি সম্পূর্ণ করেন ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে। এর পরে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক (L.L.B.) ডিগ্রি লাভ করেন।

রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনিই প্রথম M.A. এবং L.L.B. উভয় ডিগ্রিই অর্জন করেন। 

কর্মজীবনঃ

কর্মজীবনের শুরুর দিকে, ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে, তিনি রংপুর আদালতে আইনজীবী হিসাবে কাজ করেন।

কর্মক্ষেত্রে তিনি লক্ষ্য করেন যে অধিকাংশ আইনজীবী উচ্চবংশীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, এবং আইনজীবীদের মধ্যে হিন্দুধর্মের পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যায় নগন্য। পিছিয়ে পড়া রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ হিসাবে তাঁকে কর্মক্ষেত্রে বিদ্রূপেরও সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

রংপুরে তিনি তাঁর একজন সহকর্মীর একদিন টোগা (উকিলের গাউন) ব্যবহার করে কর্মক্ষেত্রে গমন করেন। অচিরেই তিনি ভুল বুঝতে পারেন, এবং টোগাটি তিনি তাঁর সহকর্মীকে ফেরত দেন। উচ্চবর্ণের আইনজীবী সহকর্মী কিন্তু সেই টোগা ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানান, কারণ নিম্নবর্ণের মানুষ পঞ্চানন বর্মার পরিহত টোগা তিনি পরিধান করতে চাননি।

উপরের এই ঘটনা পঞ্চানন বর্মার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। তিনি বুঝতে পারেন যে হিন্দুধর্মে জাতপাত ভেদাভেদ কতখানি প্রবল। 

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনায় কোচবিহারের রাজবংশী সম্প্রদায়কে ক্ষত্রিয় হিসাবে পরিগণিত করা হয় নি। এই অস্বীকৃতি তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি।

ক্ষত্রিয় আন্দোলনঃ

তিনি বাংলার বর্ণবাদী হিন্দুদের অবহেলা ও ভেদাভেদের শিকার রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষত্রিয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি উত্তরবঙ্গের ক্ষত্রিয়দের অবহেলিত ক্ষত্রিয় থেকে আর্য জাতির পৌন্ড্রক্ষত্রিয় হিসেবে উচ্চবর্ণের বাঙালিদের শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি অর্জন করতে এই আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। 

তিনি মনে করেছিলেন রাজবংশীদের নিজেদের অধিকার এবং সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য সংগঠিত ও শিক্ষিত হওয়া অবশ্যকর্তব্য, যা তিনি ক্ষত্রিয় সভার মাধ্যমে অর্জন করার চেষ্টা করেছিলেন। এই সমিতিটি প্রমাণ করে যে রাজবংশীরা রাজক্ষত্রিয় ছিলেন, এবং কোচবিহারের রাজা বিশ্ব সিংহের সাথে তাদের ঐতিহাসিক ভাবে যোগসূত্র রয়েছে। 

সংস্কৃত সাহিত্য এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের লেখার উপর ভিত্তি করে জানা যায় যে রাজবংশীরা পরশুরামের (পুরাণের মতে পরশুরাম একুশবার পৃথিবীকে নিক্ষত্রিয় করেছিলেন) ভয়ে নিজেদের ক্ষত্রিয় পরিচয় গোপন করেন, এবং নিজেদের ভূমি ত্যাগ করে পৌণ্ড্রবর্ধনে আশ্রয়গ্রহণ করেন। তাঁরা এমনকি নিজের পরিচয় গোপন করার জন্য বৈদিক উপাচারও ত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে এঁরা ব্রাত্য ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত হন।

এই দাবির সমর্থনে এই আন্দোলনটি একটি আনুষ্ঠানিক ক্ষত্রিয়করণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। বাংলা ১৩১৯ সালের ২৭ মাঘ পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে লক্ষাধিক রাজবংশীর গণউপনয়ন করা হয়। ফলতঃ, উত্তরবঙ্গের গ্রামগুলিতে কয়েক হাজার রাজবংশীকে ‘ক্ষত্রিয় রাজবংশী’ হিসাবে প্রমাণ করার জন্য তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ্য রীতিনীতির পুনঃপ্রবর্তন করা হয়।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে তৎকালীন কোচবিহারের রাজা কোনোদিনই এই আন্দোলনকে স্বীকৃতি দেননি। তাঁরা রাজবংশীদের মিলনক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপের চেষ্টা করেন। 

রাজনীতিঃ

রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি। ফলতঃ, তিনি রাজবংশীদের অধিকার এবং সম্মান পুনরুদ্ধারের দাবীকে রাজনৈতিক রূপ প্রদানের চেষ্টায় মনোনিবেশ করেন। 

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেন এবং বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হন। পরবর্তী ১৯২৩ এবং ১৯২৬ নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর আন্দোলনের কোচবিহার রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। কেবল বিশেষ অনুমতিসাপেক্ষেই তাঁর কোচবিহার প্রবেশের অনুমতি ছিল। 

সমাজ সংস্কারঃ

তিনি রাজবংশীদের জন্য ১৩১৭ সালের ১৮ জ্যৈষ্ঠ রংপুর জেলায় ক্ষত্রিয় সমিতি তৈরি করেন। তিনি রংপুর জিলা স্কুলে রাজবংশী ছাত্রদের আবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য ক্ষত্রিয় ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করেন। দরিদ্র রাজবংশীদের সহায়তা করতে তিনি কুড়িগ্রামে ক্ষত্রিয় ব্যাংক স্থাপন করেন। এছাড়াও তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি ক্ষত্রিয় পত্রিকা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। রাজবংশী সম্প্রদায়ের অবস্থার উন্নতির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি চাকরিতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন।

তিনি রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তার সম্প্রদায়ের মধ্যে সাহিত্য বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রকাশিত রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় ১৩১৩ থেকে ১৩১৯ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। 

সাহিত্যকীর্তিঃ

তিনি কামতাপুরী ভাষায় ছোটগল্প এবং কবিতা রচনা করেছিলেন। 

মৃত্যুঃ

পঞ্চানন বর্মা ১৯৩৩ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর কলকাতায় পরলোকগমন করেন।

পরবর্তী ইতিহাস এবং স্বীকৃতিঃ

রাজবংশী সম্প্রদায়ের অধিকার আদায় এবং তাদের অবস্থার উন্নতিকল্পে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার কর্তৃক তিনি ‘রায় সাহেব’ এবং মেম্বার অফ ব্রিটিশ এম্পায়ার (M.B.E.) উপাধিতে ভূষিত হন। 

অনেকেই তাকে রাজবংশী জাতির জনক হিসেবে অভিহিত করেন। 

২০১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ তার নাম অনুসারেই করা হয়। 

To check our latest Posts - Click Here

Telegram

কুদ্দুস ভাই

World History, Content Writer @ www.banglaquiz.in

Related Articles

Back to top button