NotesCurrent Topics

নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবস – ১৮ই জুলাই

Nelson Mandela International Day - 18 July

নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবস

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলার সম্মানে প্রতি বছর ১৮ই জুলাই নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবস বা ম্যান্ডেলা দিবস পালন করা হয়ে থাকে। আজ ১৮ই জুলাই দেখে নেওয়া যাক এই মহান মানব সম্পর্কিত কিছু তথ্য।

ম্যান্ডেলা দিবসের ইতিহাস

২০০৯ সালের ২৭ শে এপ্রিল নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশন সমগ্র বিশ্ববাসীকে ম্যান্ডেলা দিবস পালনের জন্য আহ্বান জানায়। এই দিনটিকে ছুটির দিন হিসেবে না রেখে তারা নেলসন ম্যান্ডেলার আদর্শে সামাজিক সেবামূলক কাজকর্মের দিন হিসেবে স্থির করেন। ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে নেলসন ম্যান্ডেলার সম্মানে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিক ভাবে “নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবস” উদযাপনের ঘোষণা করে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুলাই নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিনে সর্বপ্রথম এই আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হয়।

দেখে নেওয়া যাক দক্ষিণ আফ্রিকার জাতির জনক নেলসন ম্যান্ডেলা সম্পর্কিত কিছু তথ্য।

জন্ম ও পরিবার

নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯১৮ সালের ১৮ই জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন কেপ প্রদেশের থেম্বু রাজবংশের ক্যাডেট শাখায় উমতাতার নিকটবর্তী ম্‌ভেজো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

ম্যান্ডেলার বাবা গাদলা হেনরি মপাকানইসা ম্যান্ডেলা ম্‌ভেজো গ্রামের মোড়ল ও শাসকের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ম্যান্ডেলার মাতা ছিলেন গাদলার তৃতীয় স্ত্রী নোসেকেনি ফ্যানি।

শিক্ষা

আমার পরিবারের কেউ কখনো বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেননি … বিদ্যালয়ের প্রথম দিন আমার শিক্ষিকা ম্‌দিঙ্গানে আমাদের প্রত্যেকের ইংরেজি নাম রাখেন। সে সময়ে আফ্রিকানদের মধ্যে এটি একটি রীতি ছিল এবং তা নিঃসন্দেহে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্রিটিশ পক্ষপাতের কারণে। সেদিন ম্‌দিঙ্গানে আমাকে বলেন আমার নতুন নাম নেলসন। এই নামটিই কেন তা সম্পর্কে আমার কোন ধারণ নেই।- নেলসন ম্যান্ডেলা, ১৯৯৪

নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন তাঁর পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। ৭ বছর বয়সে তিনি স্থানীয় মেথডিস্ট বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।

ম্যান্ডেলার শিক্ষিকা ম্‌দিঙ্গানে তাঁর ইংরেজি নাম রাখেন “নেলসন”।

১৯৩৩ সালে ম্যান্ডেলা এঙ্গকোবোর ক্লার্কবারি মেথডিস্ট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভর্তি হন। সেখানে ম্যান্ডেলা ৩ বছরের জায়গায় মাত্র ২ বছরেই জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষায় পাস করেন।

১৯৩৭ সালে ম্যান্ডেলা ফোর্ট বোফোর্ট শহরের মিশনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হেল্ডটাউন স্কুলে ভর্তি হন। ম্যান্ডেলা হেল্ডটাউনে থাকাকালীন অবসর সময়ে দৌড় ও মুষ্টিযুদ্ধের মতো খেলাধুলায় নিয়মিত অংশ নিতে শুরু করেন। এর পরে তিনি ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টস কোর্সে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে ম্যান্ডেলা উইটওয়াটার্সরান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরু করেন। এখানে তিনিই একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান শিক্ষার্থী ছিলেন এবং বর্ণবাদের শিকার হন।

রাজনৈতিক জীবন

ম্যান্ডেলা ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)-এর জাতীয় নির্বাহী হিসেবে জুমার স্থলাভিষিক্ত হন।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে এএনসি ভারতীয় ও কমিউনিস্টদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রকাশ্যে বিরোধিতার প্রস্তুতি নেয়, এবং স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের লক্ষ্যে জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক বোর্ড গঠন করে। এই আন্দোলনের মূলত মহাত্মা গান্ধীর দর্শন দ্বারা প্রভাবিত অহিংস আন্দোলনের নীতিকে গ্রহণ করে বর্ণবাদের বিরোধিতা করেছিল। ২২শে জুন ডারবানে এক মিছিলে ম্যান্ডেলা ১০,০০০ লোকের এক সমাবেশ সহযোগে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করলে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং অল্প সময়ের জন্য মার্শাল স্কয়ার কারাগারে বন্দি রাখা হয়।এই সকল কার্যাবলি ম্যান্ডেলাকে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে খ্যাতি পাইয়ে দেয়। আরও বিক্ষোভের পর এএনসির সদস্য ২০,০০০ থেকে ১০০,০০০ বৃদ্ধি পায়। সরকার গণ-গ্রেফতার শুরু করে এবং মার্শাল আইন জারি অনুমতি সাপেক্ষে জন-নিরাপত্তা আইন, ১৯৫৩ চালু করে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর তারিখে ম্যান্ডেলাসহ ১৫০ জন বর্ণবাদবিরোধী কর্মীকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেপ্তার করে। এই মামলাটি সুদীর্ঘ ৫ বছর ধরে (১৯৫৬-১৯৬১) চলে, কিন্তু মামলার শেষে সব আসামি নির্দোষ প্রমাণিত হন।

বন্দীজীবন

কিছুতেই বর্ণবাদী সরকার পিছু না হতে অবশেষে নেলসন ম্যান্ডেলা গেরিলা যুদ্ধের পথ বেছে নেন এবং অনুগামীদের জন্য অর্থ জোগাড় ও সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য কাজ শুরু করেন। বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু এতে অনেক বেসামরিক লোক হতাহত হন। পরবর্তীকালে নেলসন ম্যান্ডেলা গ্রেফতার হন ও ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ অক্টোবর শ্রমিক ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেওয়া এবং বেআইনিভাবে দেশের বাইরে যাওয়ার অভিযোগে ম্যান্ডেলাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এর দু-বছর পর ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জুন ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে এএনসি-র সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্বদানের অভিযোগ আনা হয় ও শাস্তি দেওয়া হয়। ম্যান্ডেলার ফাঁসির অর্ডার হলেও ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুন দেওয়া রায়ে ফাঁসির বদলে তাদের সবাইকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

ম্যান্ডেলার কারাবাস শুরু হয় রবেন দ্বীপের কারাগারে। এখানে তিনি তার ২৭ বছরের কারাবাসের প্রথম ১৮ বছর কাটান। জেলে থাকার সময়ে বিশ্বজুড়ে তার খ্যাতি বাড়তে থাকে। কারাগারে থাকার সময়ে ম্যান্ডেলা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় পড়াশোনা শুরু করেন এবং আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ম্যান্ডেলাকে রবেন দ্বীপের কারাগার থেকে পোলস্‌মুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ম্যান্ডেলাকে ভিক্টর ভার্সটার কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হয়।

মুক্তি

১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি বোথা হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তার স্থলাভিষিক্ত হন ফ্রেডেরিক উইলেম ডি ক্লার্ক। রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনের পরেই ডি ক্লার্ক ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ম্যান্ডেলার কারামুক্তির ঘটনাটি সারা বিশ্বে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। মুক্তির দিনে ম্যান্ডেলা জাতির উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি শান্তি রক্ষা করা ও দেশের শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য আহবান জানান।

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই পর্যন্ত ম্যান্ডেলা ও এএনসি কর্মীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা থেকে নিষিদ্ধ ছিল। কেবলমাত্র নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে তাদের আসার অনুমতি ছিল। এর কারণ ছিল ম্যান্ডেলার ষাটের দশকের সশস্ত্র আন্দোলনের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানীন্তন সরকার ম্যান্ডেলা ও এএনসিকে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে ঘোষণা করেছিল। ২০০৮ খ্রস্টাব্দের জুলাইতে এসেই কেবল ম্যান্ডেলাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রণীত সন্ত্রাসবাদীদের তালিকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি

১৯৯৪ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা  দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন জিতে যান এবং ১০ই মে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। দেশের কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের উন্নয়নের জন্য তিনি প্রচুর কাজ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি Truth and Reconciliation Commission গঠন করেন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি ছিলেন ।

ম্যান্ডেলার লেখা গুরুত্বপূর্ণ বই

  • I Am Prepared to Die
  • No Easy Walk to Freedom
  • In His Own Words
  • The Struggle Is My Life
  • Long Walk to Freedom ( নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মজীবনী )
  • Dare Not Linger: The Presidential Years (মরণোত্তর প্রকার করা হয় ২০১৭ সালে )

পুরস্কার

নেলসন ম্যান্ডেলা তার জীবনে ২৬০ এরও অধিক পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।

  • ১৯৭৯ সালে তিনি আন্তর্জাতিক বোঝাপড়ার জন্য জওহরলাল নেহেরু পুরষ্কার পান।
  • ১৯৮১ সালে তিনি মানবাধিকারের ক্ষেত্রে যোগ্যতার জন্য ব্রুনো ক্রেস্কি অ্যাওয়ার্ড পান।
  • ১৯৮৩ সালে তিনি রোমের সাম্মানিক নাগরিকতা লাভ করেন।
  • ১৯৮৩ সালে তিনি গ্রীসের সাম্মানিক নাগরিকতা লাভ করেন।
  • ১৯৮৫ সালে তিনি তৃতীয় বিশ্ব পুরস্কার লাভ করেন।
  • ১৯৮৫ সালে তিনি ব্রাজিলের সাম্মানিক নাগরিকতা লাভ করেন।
  • ১৯৮৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাহিত্যে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
  • ১৯৮৭ সালে ডাচ ফুটবল খেলোয়াড় রুড গুলিট তার European Footballer of the Year award নেলসন ম্যান্ডেলাকে উৎসর্গ করেন।
  • ১৯৯০ সালে তিনি লেলিন পুরস্কার লাভ করেন।
  • ১৯৯০ সালে তিনি ভারত রত্ন সম্মানে সম্মানিত হন।
  • ১৯৯২ সালে পাকিস্তান তাঁকে নিশান-ই-পাকিস্তান সম্মানে সম্মানিত করে।
  • ১৯৯৩ সালে অসলোতে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।
  • ১৯৯৩ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে পার্সন অফ দ্যা ইয়ার ঘোষণা করে।
  • ১৯৯৫ সালের আফ্রিকা শান্তি পুরস্কার পান।
  • ১৯৯৬ সালে ইউ থ্যান্ট শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।
  • ২০২১ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবসের থিম ছিল – One Hand Can Feed Another
  • ২০২২ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবসের থিম ছিল – do what you can with what you have and where you are.
  • ২০২৩ সালে এই দিবসের থিম ছিল – The Legacy Lives on Through You: Climate, Food, and Solidarity.

To check our latest Posts - Click Here

Telegram

Related Articles

Back to top button